কাকতালীয় হতে পারে, হতে পারে পরিকল্পিতও। কিন্তু সিলেটের শাপলাবাগ, দক্ষিণ সুরমা, জালালাবাদ, টুকেরবাজার আর মদিনা মার্কেট এলাকাকে বিশেষ পছন্দের তালিকায় রেখেছে জঙ্গিরা। ১৪ বছর আগে টিলাগড়ের শাপলাবাগ এলাকার সূর্যদীঘল বাড়ির থেকে তিন দিনের অভিযানে আটক করা হয় কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানকে।
মঙ্গলবার রাতে একই এলাকার শাহ ভিলায় পাওয়া গেল আরেক জঙ্গি আস্তানার খোঁজ। এখানেও জেএমবি, তবে নব্য জেএমবি। সেখানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সেন্টারের নামে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনার আয়োজন করেছিল তারা। নতুন করে আটক ৫ জঙ্গির দুজন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
গত ২৪ জুলাই পল্টনে পুলিশ চেকপোস্টের কাছে বিস্ফোরণ ঘটানোর পর জঙ্গিরা সিলেটে এসে পরিকল্পনা করছিল হযরত শাহজালাল (র) মাজারসহ অন্যান্য স্থানে নাশকতার।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) ভাষ্যমতে, পল্টনে বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরা সিলেটে এসে আস্তানা গাড়ার খবরে ১০ আগস্ট ভোররাতে সিলেট নগরী এবং আশপাশের কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালানো হয়। নগরীর মিরাবাজার উদ্দীপন-৫১ নম্বর বাসা থেকে আটক করা হয় নব্য জেএমবির ‘সিলেট আঞ্চলিক কমান্ডার’ নাইমুজ্জামান নাইমকে।
নাইমের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার ভোরে পৃথক দুটি অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় আরও চারজনকে। সিলেট নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকা থেকে সানাউল ইসলাম সাদী এবং শহরতলির টুকেরবাজার এলাকা থেকে মির্জা সায়েম, জুয়েল ও রুবেলকে আটক করা হয়।
পরবর্তী সময় এই পাঁচ জঙ্গির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮টায় নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকার ৪৫/১০নং বাসার মুক্তিযোদ্ধা মইনুল আহমদের বাসায় অভিযান চালিয়ে বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম এবং কয়েকটি কম্পিউটার উদ্ধার করা হয়।
অপরদিকে, জঙ্গি নাইম ও সায়েমকে নিয়ে রাত সাড়ে ৯টায় নগরীর টিলাগড়ের শাপলাবাগ আবাসিক এলাকার ৪০/এ ‘শাহ ভিলা’ নামের বাসায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত কয়েকটি কম্পিউটার জব্দ করা হয়।
বাসার মালিক শাহ মো. সামোদ আলী জানান, ‘শাহ ভিলা’ নতুন বাসা। ভবনের প্রায় সব ফ্ল্যাটই খালি। মাস দুয়েক আগে শিক্ষার্থী পরিচয়ে নাইম ও সায়েম বাসা ভাড়া নেয়। তারা সেখানে ‘কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সেন্টার’ খোলার কথা জানায়। তারা নিয়মিত ভাড়া দিচ্ছিল। জঙ্গি সন্দেহে নতুন করে ৫ জনকে আটকের বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের কেউ কথা বলতে চাননি।
মঙ্গলবার জালালাবাদে অভিযান চালানোর সময় সেখানে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান। তিনি জানান, অভিযান চালিয়ে বোমা, বোমা তৈরির এবং কিছু কম্পিউটার সরঞ্জাম উদ্ধার করে নিয়ে যায় পুলিশ। উদ্ধারকৃত কম্পিউটারে বোমা তৈরির বেশ কিছু ভিডিও ছিল।
তবে বুধবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মো. মনিরুল ইসলাম জানান, সিলেট থেকে গ্রেপ্তার পাঁচ জঙ্গি কম্পিউটার প্রশিক্ষণের আড়ালে সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল।
তিনি জানান, ধারাবাহিকভাবে অপারেশন এলিগ্যান্ট বাইট চালিয়ে সিলেটের মিরাবাজার, টুকের বাজার, দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন স্থান থেকে শেখ সুলতান মোহাম্মদ নাইমুজ্জামান (২৬), সানাউল ইসলাম সাদি (২৮), রুবেল আহমেদ (২৮), আবদুর রহিম জুয়েল (৩০) ও সায়েম মির্জাকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা নব্য জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য। তারা কথিত আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এবার ঈদুল আজহার আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে তারা গত ২৪ জুলাই ঢাকা পল্টনে পুলিশ চেকপোস্টের পাশে, গত ৩১ জুলাই নওগাঁ জেলার সাপাহার এলাকায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের মন্দিরে বোমা হামলা করে। গত ২৩ জুলাই হযরত শাহজালাল (রহ) মাজার শরীফে আরেকটি হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মধ্যে তারা পল্টন ও সাপাহারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়। কিন্তু সিলেটে পুলিশের কড়া নজরদারির কারণে ব্যর্থ হয়।
নব্য জেএমবির শূরা সদস্য শেখ সুলতান মোহাম্মদ নাইমুজ্জামানের নেতৃত্বে তারা সিলেটের শাপলাবাগের একটি বাসায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণের আড়ালে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে শেখ সুলতান মোহাম্মদ নাইমুজ্জামান কফি শপে (বারিস্তা) কপি মেকার হিসেবে কাজ করে। ২০১৯ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স সম্পন্ন করে সে। ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবিরের সক্রিয় সদস্য ছিল। সে সামরিক শাখার প্রধান প্রশিক্ষক এবং সামরিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সিলেটের শাপলাবাগের বাসাটি ভাড়া নেয়। সানাউল ইসলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র।
রুবেল আহমেদ ২০১৬ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ব্লু বার্ড সিলেট শাখা থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। সে সিলেটে টুকেরবাজারে সার, বীজ ও কীটনাশকের ব্যবসা করে। আবদুর রহিম জুয়েল রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করত। তার গাড়ি ব্যবহার করে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করেছিল। সায়েম মির্জা সিলেটের মদন মোহন কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র।
বারবার সিলেট : জঙ্গিদের হামলায় একাধিকবার কেঁপে উঠেছে এ অঞ্চল। দেশের শীর্ষ জঙ্গিরাও গ্রেপ্তার হয়েছে সিলেট থেকে। এ ছাড়া এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গিরা ঘাঁটি গড়ে তোলার বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে বিভিন্ন সময়।
২০০৪ সালে ১২ জানুয়ারি সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) মাজারে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হন ৭ জন। একই বছরের ২১ মে একই মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। ওই বছরের ৭ আগস্ট সিলেটে গুলশান হোটেলে মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মিসভায় আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সিলেটে বেশ কয়েক দফা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তদন্তে এসব বিস্ফোরণের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলে। সিলেটে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনাও ফাঁস হয়।
এ ছাড়া ২০১৭ সালে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়ায় ‘আতিয়া মহলে’ জঙ্গিবিরোধী শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। সেই অভিযানে গুলি-বোমার শব্দে কেঁপে উঠেছিল সিলেট। সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হয়েছিল চার জঙ্গি। ২৪ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন র্যাবের পরিচালক ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৭ জন। অভিযান চলাকালে দুই দফার এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা পরিস্থিতিকে করে তোলে আতঙ্কময়, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার।
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সিলেট সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়া ও বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ না করার ফলে এমনটি ঘটতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে তাদের আশ্রয়দাতা এবং রাজনৈািতক যোগসাজশও থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের।
Leave a Reply